ডালবীজ সংরক্ষণে শুসরী পোকার দমন ব্যবস্থাপনা
ড. মোঃ আলতাফ হোসেন
ডাল ফসল আমাদের পুষ্টি নিরাপত্তায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডালের আমিষ (চৎড়ঃবরহ) বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিকট সহজলভ্য একটি পুষ্টি উপাদান। আমাদের দেশে ডালের মোট চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগ আমরা উৎপাদন করে থাকি। ৬০ ভাগ ঘাটতির মধ্যে ৩০-৩৫ ভাগ আমদানি করা হয় এবং বাকিটা ঘাটতিই রয়ে যায়। ডালের আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য গবেষণার মাধ্যমে উচ্চফলনশীল জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে এবং ফলনও বাড়ছে কিন্তু কৃষক পর্যায়ে ডাল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম একটি বাধা হচ্ছে ডালবীজ সংরক্ষণে শুসরী পোকার আক্রমণ। শুসরী পোকা (ঈধষষড়ংড়নৎঁপযঁং ংঢ়ঢ়., পরিবার: ইৎঁপযরফধব, বর্গ: ঈড়ষবড়ঢ়ঃবৎধ), ডালবীজ সংরক্ষণের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। সবধরনের ডালবীজই (খেসারি, মসুর, ছোলা, মটর, গোমটর, মুগ, মাসকলাই, অড়হর ইত্যাদি) গুদামে সংরক্ষিত অবস্থায় শুসরী পোকার আক্রমণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষকপর্যায়ে ডালবীজ সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় সমস্যাই হচ্ছে শুসরী পোকার আক্রমণ। এদের আক্রমণ থেকে ডালবীজকে সুরক্ষা করার কৌশল না জানার কারণে কৃষকদের মাঝে বীজ সংরক্ষণের অনাগ্রহ দেখা যায় এবং বীজ সংগ্রহের পরপরই সেটা, যে দামেই হোক কৃষক বিক্রি করে দেন। যার ফলশ্রæতিতে বপনকালীন সময়ে কৃষকপর্যায়ে বীজের যথেষ্ট সংকট পরিলক্ষিত হয় এবং ডাল ফসলের উৎপাদন এলাকা কমে যায়। শুসরী পোকা এবং তার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কৃষকদের যদি সম্যক ধারণা থাকলে কৃষকগণ অবশ্যই বীজ সংরক্ষণে আগ্রহী হবেন, এতে করে বীজের সহজপ্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতা বেড়ে যাবে এবং বপন মৌসুমে কৃষক সহজে নিজের সংরক্ষিত বীজ দিয়েই ফসল বপন করতে পারবেন। এর ফলে ডাল ফসলের উৎপাদন এলাকা বেড়ে যাবে এবং পুষ্টি নিরাপত্তায় ডালের ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
পোকা পরিচিতি
পূর্ণবয়স্ক শুসরী পোকা ছোট ডিম্বাকৃতির বাদামি রঙের বিটল, লম্বায় ৩.০-৪.৫ মিমি.। এদের ঘারে এবং পাখার মাঝখানে ও শেষ প্রান্তে কালো দাগ আছে। পাখা পেটের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ঢাকতে পারে না বিধায় পেট পেছনের দিকে অনাবৃত থাকে। এদের মাথায় দুটি করাত সদৃশ্য লম্বা এ্যান্টেনা বা শুং আছে। পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী পোকা ডালবীজের গায়ে সাদা রঙের ছোট ছোট একাধিক ডিম পাড়ে। একটি স্ত্রী পোকা ৫০-২০০টি পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। ডিম থেকে ৩-৬ দিনের মধ্যে কীড়া বের হয়েই বীজ ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে খেতে শুরু করে। কীড়া ধাপটি হচ্ছে এ পোকার ক্ষতিকর ধাপ। কীড়াগুলো দৈর্ঘ্য প্রায় ৫-৬ মিমি. লম্বাটে এবং হলুদাভ সাদা, বাদামি মাথাযুক্ত। কীড়া ধাপ ১২-২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং পুত্তলী ধাপও বীজের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে থাকে। জীবনচক্র সম্পন্ন হতে ২৮-৪০ দিন লাগে। এরা বছরে ৬-৮ বার বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
ক্ষতির ধরন, প্রকৃতি ও মাত্রা ডাল ফসলে শুসরী পোকার আক্রমণ ফসল সংগ্রহের আগেই মাঠ থেকেই শুরু হয়ে থাকে। ফসল পাকা শুরু করলে স্ত্রী পোকা ঘরবাড়ি ও বীজ সংরক্ষণাগার থেকে মাঠে উড়ে গিয়ে পাকা ফলের গায়ে ডিম পাড়তে শুরু করে। এরপর ফসল সংগ্রহ এবং পরবর্তীতে মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও ঠাÐাকরণ ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্যেও স্ত্রীপোকা বীজের গায়ে ডিম পাড়া অব্যাহত রাখে এবং স্ত্রী ও পুরুষ উভয় পোকা বীজের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। এভাবে লুকিয়ে থাকা পূর্ণবয়স্ক পোকা ও ডিমযুক্ত বীজ গুদামজাত করলে বীজের গায়ে লেগে থাকা ডিম ফুটে কীড়া বের হয়েই বীজ ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে বীজের শাঁস খায়। বীজের গায়ে সাদা সাদা ডিমের উপস্থিতি ও গোলাকার ছিদ্র দেখে এদের আক্রমণ শনাক্ত করা যায়। আক্রান্ত বীজ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং ডাল হিসেবেও খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে বীজ পাউডারের মতো গুঁড়ায় পরিণত হয়। সংরক্ষণকালে বীজের আর্দ্রতা যদি ১২% এর বেশি থাকে এবং তাপমাত্রা ২৫-৩০০ সেলসিয়াস এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬০% এর বেশি থাকে তাহলে শুসরী পোকার দ্রæত বংশবৃদ্ধি ঘটে এবং আক্রমণের মাত্রাও বেড়ে যায়। এ পোকার আক্রমণে সাধারণত গড়ে ১২-৩০% পর্যন্ত ডালবীজ নষ্ট হয়ে থাকে তবে মারাত্মক আক্রমণে ১০০% বীজই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বীজের মধ্যে শুসরী পোকার ক্রমাগত ডিমপাড়া এবং বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে ৩-৪ মাসের মধ্যে সমস্ত বীজকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। তবে বিভিন্ন ধরনের ডাল বীজে শুসরী পোকা আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা বীজের আবরণের পুরুতা, শক্ততা ও অমসৃণতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। স্ত্রী পোকা অমসৃণ বীজাবরণের চাইতে মসৃণ বীজাবরণের বীজে ডিম পাড়তে বেশি পছন্দ করে। এছাড়া বীজের আকার, আকৃতি, দৃঢ়তা এবং রংয়ের উপরও ডিম পাড়ার পছন্দক্রম নির্ভর করে আক্রমণের মাত্রা কম-বেশি হয়। গবেষণায় দেখা যায় যে, মুগের বীজ শুসরী পোকার আক্রমণের প্রতি অধিক সংবেদনশীল, অপরদিকে মটরের বীজ অধিক প্রতিরোধী। সুতরাং ডালবীজে শুসরী পোকার আক্রমণের সংবেদনশীলতার কথা চিন্তা করে একই জায়গায় সবধরনের ডালবীজ সংরক্ষণ না করাই শ্রেয়।
আদর্শ বীজ সংরক্ষণাগারের আবশ্যিক সুযোগ সুবিধা
বীজকে পোকামুক্ত রাখতে এবং বীজের সজীবতা বজায় রাখার জন্য বীজ সংরক্ষণাগার বা গুদামে নি¤েœাক্ত সুযোগ সুবিধাদি আবশ্যকীয়।
বীজ সংরক্ষণাগারে যেন মাটি থেকে রস উঠে না আসে বা বৃষ্টির পানি না ঢোকে এবং পোকামাকড়, ইঁদুর, পাখি ইত্যাদি প্রবেশ না করতে পারে সেসব দিক থেকে সুরক্ষিত থাকতে হবে। বীজ সংরক্ষণাগারে বীজ পরিদর্শন, নির্বীজন, লোডিং, আনলোডিং, পরিষ্কারকরণ ইত্যাদির প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। বীজ সংরক্ষণাগারটি বীজকে অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা থেকে সুরক্ষিত রাখে এমন হতে হবে কেননা এরা পোকার বংশবৃদ্ধিতে অনুক‚ল অবস্থা তৈরি করে।
ব্যবস্থাপনা কৌশল
বীজ সংরক্ষণের আগেই বীজ সংরক্ষণের পাত্র এবং সংরক্ষণাগারের ভেতরে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। বিশেষ করে পূর্ববর্তী বছরের সংরক্ষণকৃত কোনো কিছুর অবশিষ্টাংশ যেন না থাকে। প্রয়োজনে ভ্যাকিউম ক্লিনার ব্যবহার করতে হবে এবং সংগৃহীত ময়লা আবর্জনাসহ পোকামাকড় মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। পুরাতন বস্তাগুলোকে ১০% ম্যালাথিয়ন দ্রবণে ডুবাতে হবে অথবা ফুটন্ত পানিতে ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে বস্তাগুলোকে পোকামুক্ত করতে হবে। বীজ সংরক্ষণের আগে ভালোভাবে ঝাড়াইকৃত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বীজ পলিথিন বা ত্রিপলের উপর অথবা পাকা মেঝেতে ২-৩টি রোদ দিয়ে কট্কটে করে শুকাতে হবে যেন বীজের আর্দ্রতা ১২% এর নিচে থাকে। কোনক্রমেই বীজ শুধু মাটির ওপর শুকানো যাবে না। মাটিতে বীজ শুকালে কখনোই সবগুলো বীজ শুকনো কট্কটে হবে না। বীজের আর্দ্রতা বেশি থাকলে সহজেই শুসরী পোকা দ্বারা আক্রান্ত হবে। এ জন্য বীজ সংরক্ষণের অন্যতম প্রধান শর্তই হলো বীজকে উত্তমভাবে শুকানো। শুকনো বীজ ঠাÐা করে বায়ুরোধীপাত্রে যেমন- প্লাস্টিক বা ধাতব ড্রাম, পলিথিন লাইনিং বস্তা ইত্যাদিতে সংরক্ষণ করতে হবে। অল্প পরিমাণ বীজ সংরক্ষণের জন্য বীজের গায়ে উদ্ভিদজাত তেল যেমন- অলিভ অয়েল বা নিমের তেল প্রতি কেজি বীজের জন্য ৫-৭ মিলি হারে মিশিয়ে ছোট প্লাস্টিক পাত্রে সংরক্ষণ করা যায়। বীজের বস্তায় বা পাত্রের উপর ৩-৫ সেমি শুকনো বালির স্তর দিয়ে ঢেকে রাখা যেতে পারে। বীজের বস্তা বা পাত্র ফেটে বা ভেঙে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মাঝেমধ্যে বীজকে ৪-৬ ঘণ্টা ৩৭-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রোদে শুকিয়ে পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, এভাবে বীজ শুকানোর ফলে বীজের সজীবতা নষ্ট হবে না। বেশি পরিমাণ বীজ গুদামে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রতি টন বীজের জন্য ৪-৬টি এ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বড়ি ব্যবহার করে বীজকে পোকামুক্ত রাখা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই বায়ুরোধী করে রাখতে হবে। কৃষক পর্যায়ে বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ কেজি বীজের পাত্রে বা বস্তার মধ্যে একটি করে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বড়ি (গ্যাস ট্যাবলেট) ন্যাকড়ার পুঁটলিতে বেঁধে ঢুকিয়ে রাখলে শুসরী পোকার আক্রমণ হতে ডাল বীজকে সহজেই এবং লাভজনকভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়। য়
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত¡ বিভাগ, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইল নম্বর: ০১৭২৫-০৩৪৫৯৫ ই-মেইল : hossain.draltaf@gmail.com